✍শিতাংশু গুহ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হ’ন ৫৫ বছর বয়সে। এই স্বল্প সময়ে তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ, পতাকা ও একটি মানচিত্র দিয়েছেন। এটিই কি যথেষ্ট নয়? তার জীবন থেকে শিশুকাল, কিশোর ও যুবা বাদ দিলে থাকে ৫৫-১৮=৩৭ বছর। জেল খেটেছেন প্রায় ১৪ বছর। ৩৭-১৪=২৩ বছর। মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতি করেছেন প্রায় ১০বছর। ২৩-১০=১৩ বছর। অর্থাৎ ১৩-১৫ বছর খোলা আকাশের নীচে রাজনীতি করে তিনি বাংলাদেশ এনেছেন। সেই বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে ৩ বছর। কারাগারের রোজনামচা বা অসমাপ্ত জীবনী’র পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করা যায় একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হিসাবে। পিতার শাসন, মাতার স্নেহ, স্ত্রীর ভালবাসা, পুত্রকন্যার প্রতি তার আপত্য মমতা সবকিছু আর পাঁচটা বাঙ্গালীর মতোই সাধারণ। এই সাধারণ বঙ্গবন্ধু পুত্র, স্বামী, পিতা, ভাই হিসাবে সকল দায়িত্ব পালন করেছেন সুষ্ঠূভাবে। রাজনীতি করেছেন পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে, স্ত্রী-মাতাপিতা সবাই তাকে সাথ দিয়েছেন। জনগণের সাথে মিশেছেন ভাইয়ের মত, বন্ধু’র মত। মাঝির সাথে সখ্যতা, কয়েদিদের মাঝে দেশপ্রেম জাগানো, মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে সবাইকে আপন করে নেয়া, সকল অবস্থানে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার এক অপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন। মানুষ তাকে ভালোবেসেছে। এরই মধ্যে দিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে একজন সাধারণ মুজিব কালের আবর্তনে অনন্য, অসাধারণ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন।
সোহরাওয়ার্দী’র হাত ধরে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতি। নেতার প্রতি সন্মান ও আনুগত্য প্রদর্শনে কার্পণ্য করেননি। ‘লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান’ আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিষ্টাবান। তিনিই আবার পাকিস্তান থেকে বাইরে এসে বাংলাদেশের জন্মদাতা। পাকিস্তান স্বাধীন হলে সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম এবং বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থান করলেও নেতার মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধ তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেননি। বাংলার মাঠেঘাটে ঘুরে এবং পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতা সুলভ আচরণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম লীগের রাজনীতি বাঙ্গালীর জন্যে নয়! নেতার প্রতি শ্রদ্ধার পরও নেতার আদর্শ মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় নেননি। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু’র জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, একজন মুসলিম লীগার, মুসলিম আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনায় ‘আওয়ামী লীগ’-এ রূপান্তরিত করতে তাঁর ভূমিকা অনেক। ঐ সময়ে এটি নি:সন্দেহে এক যুগান্তরী ঘটনা। বাকি পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশকের ইতিহাস সবার জানা। এরপর ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বঙ্গবন্ধুকে বাংলার অবিসংবিদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। ৭ই মার্চ ১৯৭১-এ প্রমাণিত হয় ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ’। এরপর ২৬মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা।
আমি ইতিহাসবেত্তা নই, যা লিখছি তা মনের গরজ থেকে। আমি নিউইয়র্কে বসে তাঁর কথা বলছি, এটিও বঙ্গবন্ধু’র জন্যেই। যাঁরা তার বিরোধিতা করছেন, তাঁরাও তার দেয়া সবুজ পাসপোর্ট নিয়েই বিরোধিতা করছেন। অন্তত: এ জায়গাটুকু পর্যন্ত তাকে স্বীকার করে নিতে আপত্তি কোথায়? প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সমালোচনা হতে পারে; ওআইসি-তে যাওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, আবার বৈপরীত্য বাকশাল গঠন ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা মূলত: দেশ স্বাধীন হবার আগেই জনতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু’র অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু জাতির সম্পত্তি; আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু’র অনুসারী মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়? বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে ‘পচন’, বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের মধ্যে তা নেই? বঙ্গবন্ধু প্রেমিকরা ‘বঙ্গবন্ধু’ দোকান খুলে ব্যবসা করেন না।
১৯৭০’র নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ভোট পায় ৩৯.২%। সেবার পাকিস্তানের মোট ভোটার ছিলো ৫৬,৯৪১,৫০০। তন্মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে ৩১.২১১,২২০ এবং পশ্চিম-পাকিস্তানে ২৫,৭৩০,২৮০। ভোট পড়েছিল ৬৩%। পূর্ব-পাকিস্তানে ভোট পড়েছিল আনুমানিক ১৯,৬৬৩,০৬৯ (৬৩x৩১,২১১,২২০/১০০=১৯,৬৬৩,০৬৯) ভোট। আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ১২,৯৩৭,১৬২ ভোট। আসন না পেলেও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট পড়েছিলো ৬,৭২৫,৯০৭ (১৯,৬৬৩,০৬৯-১২,৯৩৭,১৬২= ৬,৭২৫,৯০৭) ভোট। ৬৭ লক্ষের উপর এ ভোটগুলো কাদের? ভুট্টো’র পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) পূর্ব-বাংলায় ভোট পাওয়ার কোন কারন ছিলোনা, এই ভোটগুলো ছিলো মুসলিম লীগ এবং জামাত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর। পাকিস্তানের ৩০০ আসনে ৮১টি সিট্ পেয়েছিলো পিপিপি এবং তারা ভোট পায় ১৮.৬%। তিনভাগে বিভক্ত মুসলিম লীগ পায় ১৩.৮% এবং ইসলামী দলগুলো ১৩.৯%। হিসাবটা পুরো পাকিস্তানের হলেও মুসলিম লীগ এবং ইসলামী দলগুলোর শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারে কম ছিলোনা। এরা পরাজিত হলেও সক্রিয় ছিলো, যা টের পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় পঞ্চম সংশোধনী বা ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম’। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ রূপ নেয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। আরো পরে ১৯৮৮ সালে আসে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এ সবই সেই পাকিস্তানী ধারাবাহিকতার ফসল।
আওয়ামী লীগ একাধারে ক্ষমতায় এক দশকের একটু বেশি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাতামাতি করার মানুষ বা বঙ্গবন্ধু প্রেমিকের কোন কমতি নেই, ৭৪-৭৫’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমরা এমন দৃশ্য দেখেছিলাম। তাই হয়তো রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ দু:খ করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্যে কোন বীরউত্তম, বীরবিক্রম এগিয়ে আসেননি’। কথাটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমরা কর্নেল জামিল ও কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। আমাদের রাজনীতিকরা প্রায়শ: বলে থাকেন, বিদেশ অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু’র খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর তৎপরতা চলছে। বঙ্গবন্ধু’র স্বীকৃত ও দণ্ডিত ১২ খুনির মধ্যে ৬জন বিদেশে পলাতক। ২৭ জানুয়ারি ২০১০-এ ৫জনের দন্ড কার্যকর হয়েছে। এরা হচ্ছেন, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমদ এবং একেএম মহিউদ্দিন। পলাতক ৬জন হচ্ছেন: লেঃকর্নেল (অব:) রাশেদ চৌধুরী; লেঃকর্নেল (অব:) নূর চৌধুরী; লেঃকর্নেল (অব:) শরিফুল হক ডালিম; লেঃকর্নেল (অব:) খন্দকার আব্দুর রশিদ; রিসালদার মোসলেউদ্দিন; ক্যাপ্টেন (অব:) আব্দুল মাজেদ। এদের মধ্যে লেঃকর্নেল (অব:) রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং লেঃকর্নেল (অব:) নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি ৪জন কোথায় আছেন, তা কেউ জানেইনা? বলা হচ্ছে, মেজর ডালিম হয়তো পাকিস্তানে আছেন। ১৫ আগষ্ট ভোরে ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন, তাঁর দন্ড কার্যকর করা কতটা জরুরী। দণ্ডিত আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুইতে মারা গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি রাশেদ চৌধুরীর ফাইল নড়াচড়া হচ্ছে। কতটা কি হবে বলা মুশকিল। শর্ত থাকা অসম্ভব কিছু নয়? চীনের সাথে মাখামাখি যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো চোখে দেখছে বলে মনে হয়না! হয়তো এজন্যে বিদেশমন্ত্রী সদ্য বলেছেন, ‘ভারতের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক; চীনের সাথে ব্যবসা’র’। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক ভালো, তবে ‘মধুর’ বলা যাবেনা। রোহিঙ্গা রাজনীতিতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ বন্ধুহীন। তাই, রাশেদ চৌধুরীকে ফিরে পেতে ‘গিভ এন্ড টেক’ নীতি কার্যকর হবে বলে প্রতীয়মান হয়? যাহোক, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি? বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ মন্ত্রী মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল পঁচাত্তরের পর বলেছিলেন, ‘দেশ আজ ফেরাউন মুক্ত হলো’। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হ’ন। এইচ টি ইমাম পঁচাত্তর পরবর্তী মুশতাক সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব ছিলেন। জাসদের হাসানুল হক ইনু’র ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেয়ার ছবিটি ইতিহাস, তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন। তোফায়েল আহমদ’র বয়স হয়েছে। আশা করবো, সেদিনের ঘটনার একটি সত্য ও বস্তুনিষ্ট বর্ণনা তিনি লিখে রেখে যাবেন, যাতে তার মৃত্যু’র পর জাতি সেটি জানতে পারে! পঁচাত্তরের পর সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তিনি দলছুট এবং মাঝে-মধ্যে আবোলতাবোল বকছেন। তখন আরো কিছু নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিলো, যাদের কথা কেউ বলেনা, বা জানেনা। এরা অনেকেই তখন কলকাতা পাড়ি জমিয়েছেন।
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাঁর পরেই ছিলেন রংপুরের সুনীল গুহ। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীপঙ্কর তালুকদার তখন কাদের সিদ্দিকীর ঘনিষ্ট সহযোগী ছিলেন। কলকাতায় তখন যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে নরসিংদীর এমপি মোসলেউদ্দিন; যশোরের এমপি রওশন আলী; সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য যশোরের সুবোধ সরকার; শেখ ফজলুল করিম সেলিম; জাতীয় ছাত্রলীগের ইসমাত কাদির গামা; জাতীয় যুবলীগের খালেদ খুররম; আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকী; ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের; হরেকৃষ্ণ দেবনাথ, আওরঙ্গ এবং আরো অনেকে। ছাত্রলীগ নেতা নুরু হত্যা কাদেরিয়া বাহিনীতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে যেমনি বরিশালের চিত্ত সুতারের বিশাল ভূমিকা ছিলো, পঁচাত্তর পরবর্তীতেও তিনি ছিলেন আশ্রয়স্থল। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তার সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখতেন। কাদেরিয়া বাহিনী কেন ব্যর্থ হয় সেটা অন্য কাহিনী। কিন্তু ওই সময়কার অনেক ছাত্রনেতা হারিয়ে গেছেন। সফল তালিকার শীর্ষে ওবায়দুল কাদের। ভারত থেকে ফিরে তিনি ধরা পড়েন, অত্যাচারিত হন। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি, এখন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিবিধ কারণে তখনকার নেতাকর্মীরা এদিক-ওদিক ছিটকিয়ে পড়লেও এদের ভোলা অনুচিত। কাদের সিদ্দিকী পারেন ঐ অনুল্লিখিত ইতিহাস লিখে রেখে যেতে।
আওয়ামী লীগ যেমন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মত নেতা জন্ম দিয়েছে, তেমনি মুশতাক আহমদ’র মত বিশ্বাসঘাতকেরও জন্ম আওয়ামী লীগের ভেতরে। কাদেরিয়া বাহিনীর সংগ্রামের ব্যর্থতার পেছনেও এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারত-ভীতি কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু’র আওয়ামী লীগ তার মৃত্যু’র ঠিক পরই ভোল পাল্টে ‘জয়বাংলা’ চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো? বর্তমান আওয়ামী লীগের চেহারাটা এখন কেমন? মদিনা সনদ, হেফাজতের সাথে সখ্যতা, মডেল মসজিদ ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র নির্মাণ, কওমি সনদের স্বীকৃতি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ঠিক মানায় না? এটি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তা চেনাই যায়না! মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয়বাংলা’, নেতাকর্মীরা এখনো দেন, কিন্তু তাদের অনেকের মনন ও চেতনায় ‘জিন্দাবাদ’। কারণ, হয়তো অনুপ্রবেশ। না, আরো কিছু আছে? বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্যে অনেকেই এখনো নেতাদের দায়ী করেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু’র আওয়ামী লীগের বর্তমান ‘আবছা চেহারা’ বা জননেত্রী শেখ হাসিনার কিছু হলে, নেতৃবৃন্দ দায়ী থাকবেন বটে!! বঙ্গবন্ধুর দলটির দুর্দশার কারণে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী’র মত দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীবা বা শফি হুজুরের মত স্বাধীনতা বিরোধীদের বিশাল জনপ্রিয়তা এবং এমনকি সাঈদী মৃত্যদন্ড থেকে রেহাই পেয়ে যান, বা শফি হুজুর ‘জামাই আদরে’ থাকেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশে মানুষ এখন দিনে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে রাতে সাঈদীর ওয়াজ শুনে ঘুমাতে যায়?
বঙ্গবন্ধু হত্যার তিনধারায় বিচার হওয়া দরকার ছিলো। রাজনৈতিক, বিদেশী সম্পৃক্ততা এবং সামরিক সংযোগ। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয় জানা দরকার। সামরিক বাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট হওয়া উচিত। তখনকার তিন বাহিনী প্রধানের ভূমিকা কি ছিলো জানা দরকার। বিদেশী ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়া উচিত। আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের সময় কি এখনো হয়নি? ‘কান টানলে মাথা আসে’, এ উদৃতি আবারো প্রমাণিত হবে, যদি আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিশদ তদন্ত হয়; বেরিয়ে আসবে ৩-৭ই নভেম্বরের তথাকথিত সংহতি দিবস ষড়যন্ত্রের কাহিনী। জিয়া হত্যাকান্ড, জেনারেল মনজুর হত্যাকান্ড, ক্যামেরা ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে ১৩ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও অসংখ্য সেনা অফিসার, জোয়ানের ফাঁসি’র ইতিহাস মানুষের জানা দরকার। ১৯৭৭’র ০২রা অক্টবরের সামরিক অভ্যুথানের ইতিহাস জানা দরকার। কাউকে হেয় করা বা প্রতিশোধ নয়, জাতি’র কল্যানেই ওসব জানা দরকার। আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের পরপরই ১৬ আগষ্ট দুপুরে জেনারেল জিয়া ও খালেদ মোশাররফ নুতন সরকারকে অভিনন্দন জানান। অথচ খালেদ মোশাররফ নাকি আওয়ামীপন্থী? একইদিন, ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকা বলেছিলো: ‘এ করুন মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে লেখা ছিলো তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টি’র কোন প্রয়োজন ছিলোনা’। ২০২০’ -এ দাঁড়িয়ে কি একইভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ যদি মিনি পাকিস্তানই হবে তাহলে কি দরকার ছিলো এই স্বাধীনতার?
পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু’র ঘাতকরা যেভাবে পুরুস্কৃত হয়েছিলেন এর একটি হিসাব আমরা পাই বাংলাদেশ গেজেট (৮/৬/১৯৭৬) থেকে: কর্নেল শরিফুল হক ডালিম চীনা বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিবের দায়িত্ব পান; লেঃ কর্নেল: আজিজ পাশা, প্রথম সচিব, আর্জেন্টিনা; মেজর মহিউদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব, আলজেরিয়া; মেজর শাহরিয়ার রশীদ: দ্বিতীয় সচিব, ইন্দোনেশিয়া; মেজর বজলুল হুদা: দ্বিতীয় সচিব, পাকিস্থান; মেজর নূর চৌধূরী: দ্বিতীয় সচিব, সৌদী আরব; মেজর শরীফুল হোসেন: দ্বিতীয় সচিব, কুয়েত; ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম: দ্বিতীয় সচিব, আবুধাবী; লে. খায়রুজ্জামান: তৃতীয় সচিব, মিশর; লে. আবদুল মাজেদ, তৃতীয় সচিব, সেনেগাল; লে. নাজমুল হোসেন: তৃতীয় সচিব, কানাডা। কারা এদের নিয়োগ দিয়েছেন অথবা কারা এদের দীর্ঘদিন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, তা সবার জানা, হয়তো সেই পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত করছেন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামাত। পাপ বাপকেও ছাড়েনা, এটি বহু পুরাতন উবাচ, কিন্তু রাজনীতিকরা প্রায়শ: তা ভুলে যান। বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সরকারি প্রশ্রয়ে মৌলবাদের যে রমরমা, এটি পাপ, এটি হওয়ার কথা ছিলোনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাসীন, তারপর কি? তার-আর-পর নেই? সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। একদা কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের পর মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ ১৯৭২ এর সংবিধানে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছিল, ধর্মনিরপক্ষেতা ছিলো সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। সেই বাংলাদেশে এখন মৌলবাদীদের রমরমা! বঙ্গবন্ধ’র মৃত্যু মানেই কি ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যু?