Breaking Posts

6/trending/recent
Type Here to Get Search Results !

বিজয়া দশমীর প্রকৃত অর্থ



© শ্রী তপন কুমার ঘোষ  

"দশমী" না হয় বোঝা গেল, কিন্তু "বিজয়া দশমী'র" মানেটা কি?

গ্রামের বাঙ্গালি হিন্দু মনে করে বিজয়া মানে মা দুগ্গার বিসর্জন। শহরের বাঙ্গালি মনে করে বিজয়া মানে সামাজিক প্রথা - পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়। ছােটরা মনে করে বিজয়া মানে বড়দেরকে প্রণাম করে নারকেল নাড়ু বা মিষ্টি খাওয়া। সব মিলিয়ে বিজয়া মানে একটা উৎসব, আনন্দ, হৈ হৈ। আর এই সব হবে মা দুর্গাকে জলে ভাসানাের পর। আচ্ছা, দুর্গাকে তাে বাঙালি ঘরের মেয়ে মনে করে। বৎসরান্তে তার বাপের বাড়িতে আসা। আমরা তার বাপের বাড়ির লােকজন। তাই তাঁর আসা উপলক্ষে আমাদের এত আনন্দ। সেই মেয়ে চারদিনের ছুটির শেষে আবার যখন তাঁর পতি গৃহে ফিরে যাচ্ছে, আবার একবছর তাঁর দেখা পাবো না, চোখের জলে আমরা তাঁকে বিদায় দিচ্ছি, ঠিক তারপরেই এত আনন্দ উৎসব, এত মিষ্টি খাওয়া হিসাবে মেলে কি ? ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যাচ্ছেনা ?
আর এর নাম "বিজয়া" - ই বা কেন ?
কোনাে ডিক্সনারিতে কি পাওয়া যাবে বিসর্জন বা বিদায় শব্দের সঙ্গে বিজয় শব্দটির কোন সম্বন্ধ আছে ? তাহলে মা দুর্গাকে যখন চোখের জলে বিদায় দিচ্ছি ঠিক তার পরেই বিজয় শব্দটাইবা এল কি করে, আর আনন্দ উৎসবই বা কেন ?
আহা, বাঙালি যদি এর কারণটা জানত, তাহলে আজ বাংলার চেহারাটাই অন্য রকম হত। শুধু এ বাংলাটাই নয়, ও বাংলাটাও। বাংলার বাইরে অনেকে প্রশ্ন করে, দুর্গাপূজা বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব। এই উৎসবে বাঙালি আনন্দে মাতােয়ারা হয়ে ভেসে যায়। তাহলে বাংলায় নাস্তিক কমুউনিষ্টদের এত প্রভাব কেন ? দুর্গা-কালী ভক্ত এই বাংলায় অধার্মিক কম্যুনিষ্টরা কি করে ৩০ বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ?
বিজয়ার প্রশ্ন, আর এই কম্যুনিষ্ট প্রশ্ন - দুটো প্রশ্নেরই উত্তর এই যে বাঙালী পূজো করে আর বিজয়া করে, দুটোই না বুঝে। তাই দুর্গাপূজাকে বছরের বৃহত্তম উৎসব হিসাবে নিয়েও সম্পূর্ণ পূজা বিরােধী কমুনিষ্ট পার্টির ঝান্ডা ধরতে ভােট দিতে বাঙ্গালির কোনাে অসুবিধা হয় না। এটা কি বাঙালির আত্মপ্রবঞ্চনা, দুমুখাে সুবিধাবাদী নীতি ? অনেকটা, সবটা নয়। অজ্ঞতাও বটে। সুবিধাবাদী নীতি ও অজ্ঞতার যােগফল।
অজ্ঞতাটা কি ?
ধর্ম সম্বন্ধে না জানা। বিজয়া সম্বন্ধে না জানা। না জেনে পালন করা। জানলে হয়ত করত না। কী করত না ? হয় ধর্ম করত না, অথবা কমিনিজম করত। কারণ ধর্ম করে মার্কসবাদ করা যায় না এবং মার্কসবাদ করে ধর্ম করা যায় না। এই অজ্ঞানতা যদি আরও দীর্ঘদিন চলে, তাহলে কোনদিন হয়ত দেখব মা দুর্গার পিছনের চালিতে মাথার উপর যেখানে শিবের ছবি থাকে, সেখানে মার্কসের ছবি ঢুকে গেছে। তখন কে বেশি অসন্তুষ্ট হবে মার্কস না মা দুর্গা -বলা কঠিন।
এখন আসা যাক বিজয়ার প্রশ্নটাতে। বিদায়, বিসর্জন, গঙ্গার ধারে আঁখি ছলােছলাে, তার সঙ্গে মিষ্টি খাওয়া, শুভেচ্ছার কোলাকুলি, পােস্টকার্ড, গ্রিটিংস কার্ড, SMS- এর মিল কোথায় ? এর উত্তরটা ভালােভাবে দেওয়া যাক। বহুদিক থেকেই এই উত্তরটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই উত্তরটা ভালােভাবে জানতে গেলে এর সঙ্গে জড়িত আর একটা প্রথার ব্যাপারে জানতে হবে। তা হল বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের আগে সধবা মহিলাদের সিঁদুর খেলা। এই সিঁদুর খেলার সঙ্গে বিজয়ার প্রণাম, কোলাকুলি, মিষ্টি খাওয়া অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।
আসা যাক উত্তরে। মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে মহিষরূপী মহিষাসুর বধ করলেন মা দুর্গা। সেখান থেকে দৈত্য রূপ নিয়ে বেরিয়ে এল ঐ অসুর। নবমী তিথিতে তাকে বধ করলেন মা দুর্গা। বিজয় লাভ সম্পূর্ণ হল। তাই দশমীতে পালন হল বিজয় উৎসব, নাম যার বিজয়া বা বিজয়া দশমী। এই ঘটনা ঘটেছিলাে সত্য যুগে। কোন এক বসন্ত কালে। এল ত্রেতা যুগ। অধার্মিক অত্যাচারী পরনারী হরণকারী রাবণকে ধ্বংস করার জন্য রামচন্দ্র দেবী দুর্গার পূজার আয়ােজন করলেন। সে সময় বসন্ত কাল ছিল দুর্গাপূজার জন্য। কিন্তু রামের হাতে সময় নেই। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাই শরৎ কালে অকালেই দেবীর পূজা করলেন। যুদ্ধে রাবণ বধ হল। সুতরাং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে দেবী দুর্গার আরাধনা করলে যুদ্ধে জয় লাভ হয়। তাই বিজয়া দশমী শুধু বিজয় লাভের জন্য উৎসবই নয়, ওই দিনটা বিজয় লাভের জন্য, যুদ্ধ শুরু করার জন্য একটা শুভ দিন পবিত্র দিন হিসাবেও গণ্য হতে লাগল। সুতরাং ক্ষত্রিয় রাজাদের কাছে ওই দিনটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠলাে। বিজিগীষু রাজারা তাদের রাজ্যের সীমা বাড়ানাের জন্য ওই দিন যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলেন। শুরু হয়ে গেল নতুন পরম্পরা। ওই দিনটা পালিত হতে লাগল ‘“সীমােল্লঙঘন দিবস”' হিসাবে। নিজের সীমা অতিক্রম করে অভিযান করা। উদ্দেশ্য রাজ্য বাড়ানাে।
এখন রাজা যখন যুদ্ধে যাবেন, একা তাে যাবেন না। তাঁর সঙ্গে সৈন্য দল যাবে। এই সৈন্য তাে প্রজাদের মধ্য থেকেই আসে। তারাও যুদ্ধে যাবে। আর সবাই জানে যুদ্ধে গেলে বাঁচা-মরার নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধে সে আহত বা নিহতও হতে পারে। এক বিপদ সংকুল অনিশ্চিত যাত্রা। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা হবে কিনা ? তার নিজের এবং আত্মীয় পরিজনের, বন্ধুবান্ধবের, স্ত্রী-পুত্র কন্যার। তাই সে যুদ্ধে যাবার আগে সকলের কাছে বিদায় নিতে যায়। বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে যায়।
বড়রা গুরুজনরা আশীর্বাদ করেন এবং মিষ্টি খাওয়ান। ছােটরাও তাকে প্রণাম করে ও আশীর্বাদ নেয়। আর সে তার বন্ধু বান্ধব সমবয়স্কদের আলিঙ্গন কোলাকুলি করে বিদায় গ্রহণ করে। তারাও তাকে বিদায় শুভেচ্ছা জানায়। আর ঐ যে সৈন্যটি, তার স্ত্রী তাে হবে সব থেকে বেশি উৎকণ্ঠিতা। কে জানে তার স্বামী ফিরবে কিনা ? যদি না ফেরে তাহলে সে হবে বিধবা। এরকম অনেক স্ত্রী তাই তারা যায় মা দুর্গার কাছে, ওই দিনই সিঁদুর ঢালে মা দুর্গার পায়ে। তারপর সেই সিঁদুর পরিয়ে দেয় পরস্পরের সিঁথিতে। আশা-- মা দুর্গার চরণছোঁয়া সিঁদুর, এ তাে পবিত্র, এর তাে অনেক শক্তি। এই সিঁদুর আমার সিঁথিতে পরালে কারাে শক্তি নেই এই সিঁদুর মােছে। এ সিঁদুর হবে অক্ষয়। সুতরাং আমার স্বামী যুদ্ধে নিরাপদ থাকবে। সেই আশায় সিঁদুর পরানাে। তাই এই সিঁদুর খেলা। একটু পরেই স্বামী বেরােবে সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধে। সুতরাং এই সিঁদুর খেলা। এবং বিজয়ার প্রণাম কোলাকুলি মিষ্টি খাওয়া এ কোনােটাই আনন্দের উৎসব নয়। মা দুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে আনন্দ করা যায় না।
এসব হচ্ছে যুদ্ধ যাত্রার ঠিক পূর্বের কার্যকলাপ, নিরাপত্তা কামনায় এবং বিজয় কামনায়। অর্থাৎ সিঁদুর খেলা ও বিজয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আমাদের পূর্বপুরুষদের যুদ্ধ যাত্রার ইতিহাস। আজ বাঙ্গালি ওই কার্যকলাপ গুলােকে অনুষ্ঠানরূপে ধরে রেখেছে। ভুলে গিয়েছে এর ইতিহাস ও তাৎপর্যকে এবং হয়ে গিয়েছে এক যুদ্ধ বিমুখ জাত। আর পুরুষানুক্রমে এই যুদ্ধ বিমুখতা বাঙ্গালিকে পরিণত করেছে এক ভীরু কাপুরুষ পলায়নপর জাতে, যে জাত লড়তে জানে না, পালাতে জানে। তাই বাংলা ভাগ হয়, বাঙ্গালি "রিফিউজি" হয়।
এখন বিজয়াদশমী হয়ে গেছে ‘শুভদিন'। কিসের ? গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি কাজের জন্য। বাঙালি যদি বিজয়ার কোলাকুলির আসল ইতিহাসটা জানতাে, তাহলে হয়ত এমন যুদ্ধ ভীরু জাতে পরিণত হত না। কিংবা হয়ত আসল ইতিহাসটা জানলে 'ওরে বাবা দরকার নেই ' বলে প্রথাটাই বাদ দিয়ে দিত।
এখন এই ইতিহাসের অন্য একটা দিকে তাকানাে যাক। এই বাংলায় তাে ক্ষত্রিয় ছিলাে না। ইতিহাসে যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় এই বাংলায় জাত ছিল, বর্ণ বা বর্ণপ্রথা ছিল না। খুব সম্ভব বর্ণাশ্রমও ছিল না। সেইজন্যই নাকি পান্ডবরা সারা ভারত চষে বেড়ালেও বাংলায় ঢােকেনি। তাই এই বাংলাকে বলা হত পান্ডববর্জিত রাজ্য। তাহলে ক্ষত্রিয় না থাকলেও ওই প্রথা ও পরম্পরা গুলি তাে এই বাংলাতেই আমরা প্রবল ভাবে দেখতে পাই। অর্থাৎ উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয়দের মত বাঙালি যুদ্ধে যেত। এর থেকে দুটো সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসছে।
এক, বাঙালি বা এই বাংলার অধিবাসীরা যুদ্ধ করত।
দুই, বাংলা ও বাকী ভারতের ইতিহাস ও পরম্পরা একই। অতি প্রগতিশীল বামপন্থী ইতিহাসকার ও বুদ্ধিজীবিরা বাংলা ও বাঙালির উৎসবকে বাকী ভারতের থেকে আলাদা করে দেখাতে চান। তা ভুল। দেখা যাচ্ছে যে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, প্রথা ও পরম্পরা বাকী ভারতের মতই ধর্ম নির্ভর, পুরাণ ও রামায়ণ যার উৎস। সুতারং বাঙালি জনগােষ্ঠী প্রাচীন ভারতীয় জনগােষ্ঠীর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কোনভাবে পৃথক নয়।
এই ভাবে ভারতের যে কোন জনগােষ্ঠীর ইতিহাস ঠিকভাবে দেখলে একই জিনিস আমরা দেখতে পাবাে যে বিশাল ভারতের সকল জনগােষ্ঠী একই সূত্রে আবদ্ধ। এটাই আমাদের জাতীয় সংহতি। আর এর ভিত্তি ধর্ম, আমাদের হিন্দুধর্ম। এই সত্যকে যারা অস্বীকার করতে চায়, তাদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত অথবা তারা কোন বিদেশী শক্তির এজেন্টের কাজ করছে। তারা এই ঐক্যকে ভাঙ্গতে চায়, সুতরাং তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী। কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানাে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে এরা কোনাে অংশে কম ক্ষতিকর নয়। এরা জাতীয় ঐক্য ভাঙ্গতে চায়, এরা দেশ ভাঙ্গতে চায়। এদের থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। এদের জন্যই ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে, এদের জন্যই কাশ্মীর, নাগা, মিজো ও খালিস্থানী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রশ্রয় পেয়েছে। এরা জাতীয় সংহতি ভঙ্গকারী, এরা দেশদ্রোহী।

প্রথম প্রকাশ : স্বদেশ সংহতি সংবাদ (১৪ই অক্টোবর ২০০৮)

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.