Breaking Posts

6/trending/recent
Type Here to Get Search Results !

আদি সংগঠক শ্রীশঙ্করাচার্য

 


© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

বিভিন্ন মত এবং পথে শতধা বিভক্ত সনাতন হিন্দু ধর্মকে রক্ষার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে। সনাতন ধর্ম শাশ্বত এবং ঈশ্বর প্রবর্তিত পরমমুক্তির পথ। চিরকালই এ ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে; এর কোন বিনাশ নেই কারণ ঈশ্বর স্বয়ং এ ধর্মের প্রবর্তক এবং রক্ষাকর্তা। তাইতো যুগে যুগে এ ধর্ম কখনো সঙ্কুচিত অথবা কখনো প্রসারিত অবস্থায় থাকে। এমনি এক সঙ্কুচিত ঘোর দুর্দিনে ভগবানের দিব্য ঐশ্বর্যের কিঞ্চিৎ কণা নিয়ে আমাদের মাঝে আসেন এবং আলোর পথ দেখান শ্রীশঙ্করাচার্য। তাঁর জন্ম ৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দের (মতান্তরে ৭৮৮ খ্রি.) ১২ বৈশাখ শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কেরালা প্রদেশের ‘কালাডি’ নামক একটি ছোট্ট গ্রামে। পিতা শিবগুরু এবং মাতা বিশিষ্টা দেবী।জন্ম থেকেই অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা এবং ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন আচার্য শঙ্কর। মাত্র তিন বছর বয়সেই তিনি তাঁর মাতৃভাষা মালয়ালাম পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন করেন। এর ধারাবাহিকতায় তাঁর বয়স যখন সাত বছর তখন তিনি বেদবেদান্তসহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে এবং ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন পরক্ষণেই তার অবিকল বলে দিতে পারতেন।


সনাতন সত্য ধর্মের বিজয় পতাকা দিকে দিকে উড্ডীন করার জন্যে আচার্য শ্রীশঙ্কর হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। পূর্বে কামরূপ (আসাম), ঢবাক (ঢাকা) থেকে পশ্চিমে গান্ধার (আফগানিস্তান) এবং দক্ষিণে তামিলনাডু থেকে উত্তরে তিব্বত সর্বত্র তিনি প্রচার করে বেড়িয়েছেন বৈদিক ধর্মদর্শন। বৈদিক সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত এবং ঈশ্বরই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা।সম্রাট অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজকোষ শূন্য করে দিয়ে বৌদ্ধমত প্রচারের নেশায় পাগলপ্রায় হয়ে যান। তিনি যুবসমাজকে কর্মবিমুখ সন্ন্যাসের পথে প্রোৎসাহিত করেন। তিনি সৈন্যবলকে অসার ধর্মবলে রূপান্তরিত করেন। এর ফলে ভারতবর্ষের বিদেশী শক্তির প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং ভারতবর্ষ পরিণত হয় দুর্বলচিত্ত ক্লীবের দেশে। ভারতবর্ষের সাথে যুগপৎ সনাতন বৈদিক ধর্মেরও এক মহাসন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়। ভগবান বুদ্ধের প্রয়াণের কয়েকটি শতাব্দীকাল পরে বৌদ্ধমত বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এবং বিভিন্ন তান্ত্রিকপন্থায় বিভক্ত হয়ে বিকৃতি লাভ করে। সেই বিকৃতি কিছুকিছু ক্ষেত্রে ভয়ংকর অশ্লীল কামাচারে পর্যবসিত হয়ে পরে। সেই বৌদ্ধমত এদেশবাসীকে এমনভাবে গ্রাস করে যে, বৈদিক ধর্মের প্রাণকেন্দ্র কাশী (বেনারস, উত্তর প্রদেশ) পর্যন্ত নাস্তিক কুরুচিপূর্ণ মতে ম্রিয়মান হয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে কাশী তখন পূজার অভাবে গোচারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এমনি এক বীভৎস সময়ে ধূমকেতুর মত আচার্য শঙ্করের আবির্ভাব। তিনি বিভিন্ন নাস্তিক এবং অবৈদিক অপসম্প্রদায়গুলোকে স্তব্ধ করে দিয়ে সত্য সনাতনের চিরন্তন পথে আমাদের প্রবুদ্ধ করেন।


সনাতন ধর্ম পঞ্চমতে ও পথে বিভক্ত- সৌর, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ পঞ্চ মতাবলম্বীরা নিজেদের মাঝে সর্বদাই সাম্প্রদায়িক কলহে লিপ্ত থাকত। এ গুরুতর সমস্যা সমাধানে অগ্রনায়ক হলেন আচার্য শ্রীশঙ্কর। তিনিই প্রথম সর্বজনীন উপাসনা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং সব দেবতার পূজার আগে পঞ্চমতের প্রতিনিধিত্বকারী পঞ্চদেবতার (সূর্য, শক্তি, শিব, গণেশ, বিষ্ণু) পূজার বিধান দান করেন। এ বিধান প্রাচীনকালেও ছিল কিন্তু মাঝে অবলুপ্ত হয়ে যায়। আচার্য পুনঃ এ বিধান সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃঘাতী হিংসা-হানাহানী বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের পূজায় ব্যবহৃত অধিকাংশ পদ্ধতিই তাঁর নির্দেশিত। 


আধুনিক হিন্দু জাতিকে প্রথম একটি সাংগঠনিক রূপ দেন শ্রীশঙ্করাচার্য। তিনিই প্রথম সনাতন ধর্ম রক্ষায় সংঘের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেন। অবশ্য সংঘের ধারণা প্রাচীনকাল থেকে ছিল, কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণাঙ্গ এবং প্রয়োগহীন। তাঁর প্রবর্তিত সংঘই ধর্ম রক্ষায় একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ প্রতিষ্ঠানই ‘শঙ্কর মঠ’ নামে আমাদের কাছে পরিচিত। ‘শঙ্কর মঠ’ কোন একক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে ভারতবর্ষের চারপ্রান্ত থেকে চারটি মঠের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। এ চারটি মঠ ছিল সনাতন ধর্ম রক্ষায় চারটি দুর্গের ন্যায়। সিন্ধু, সৌবীর, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমাঞ্চলের জন্য শারদা মঠ; অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, উৎকল, গৌড়, সুক্ষ্ম, পৌণ্ড্র, ব্রহ্মপুত্র তীরবাসীসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জন্য গোবর্দ্ধন মঠ; কুরুক্ষেত্র, কাশ্মীর, কম্বোজসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের জন্য জ্যোতি মঠ এবং অন্ধ্র, দ্রাবিড়, কর্ণাট, কেরল প্রভৃতি দক্ষিণাঞ্চলের জন্য শৃঙ্গেরী মঠ। শ্রীশঙ্করাচার্য এ চার মঠের আচার্য হিসেবে নিযুক্ত করেন তাঁর শ্রেষ্ঠতম চার শিষ্যকে সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, তোটক এবং হস্তামলক। এ চার আচার্য চার মঠ থেকে চার বেদের পূর্ণাঙ্গ বৈদিক জীবন বিধানের শিক্ষা দিতে থাকেন দিকে দিকে। ফলে সনাতন ধর্ম একটি সুদৃঢ সাংগঠনিক রূপ পায়।


শ্রীশঙ্করাচার্য অধ্যাত্ম পথের পথিক এবং সাধারণ গৃহীদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য চার মঠের অন্তর্ভূক্ত একদল সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন যারা ‘দশনামী সন্ন্যাসী’ সম্প্রদায় নামে খ্যাত। ফলে ভারতবর্ষে তৈরি হয় শক্তিশালী এক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের অধিকাংশ ধর্মীয় মত, পথের সংগঠন এ চারমঠ এবং দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। সন্ন্যাসীর আত্মপরিচয় এই পর্যায়ে স্বামী বিবেকানন্দের বিবরণ থেকে জানা যায় ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ’ শ্রীশঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরী মঠের অধিভূক্ত একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের প্রাণপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গদেব দুজন গুরুর কাছে মন্ত্রদীক্ষা এবং সন্ন্যাস নিয়েছিলেন; তাঁরা হলেন শ্রীঈশ্বরপুরী এবং শ্রীকেশব ভারতী। তাঁরা দুজনেই শৃঙ্গেরী মঠভূক্ত সন্ন্যাসী। এমনকি যে নামে শ্রীগৌরাঙ্গদেব আমাদের মাঝে খ্যাত ‘শ্রীচৈতন্য’; এই ‘চৈতন্য’ নামটি শৃঙ্গেরীমঠভূক্ত ব্রহ্মচারী উপাধি। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যও শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত সন্ন্যাসী।শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই দশপ্রকার দশনামী সন্ন্যাসীদের সনাতন ধর্মপ্রচারে আলস্য ত্যাগ করে সদা সক্রিয় থাকার আদেশ দিয়েছেন তাঁর তৈরি 'মঠানুশাসনে'। সেই মঠের অনুশাসনে ধর্মরক্ষার্থে করনীয় বর্জনীয়  সকল সাংগঠনিক রূপরেখা পাওয়া যায়। সেই মঠানুশাসন থেকে দুটি শ্লোক উল্লেখ করছি:


যত বিনষ্টির্মহতী ধর্মস্যাত্র প্রজায়তে।

মান্দ্যং সন্ত্যাজ্যমেবাত্র দাক্ষ্যমেব সমাশ্রয়েৎ।।


ন জাতু মঠমুচ্ছিদ্যাদধিকারিণ্যুপস্থিতে।

বিঘ্নানামপি বাহুল্যাদেষ ধর্ম সনাতনঃ।। 

(মঠানুশাসনম্ : ৫, ১১)


"হে আমার সন্ন্যাসীবৃন্দ ( দশনামী), এই সময়ে ধর্মের মহতী হানি হয়েছে, তাই এই সময়ে সন্ন্যাসীদের ধর্মপ্রচারে মন্থরতা অবশ্য পরিত্যাজ্য। ধর্মপ্রচারে সর্বদা দক্ষতার আশ্রয় করবে অর্থাৎ আলস্য ত্যাগ করে ধর্মপ্রচারে সদা তৎপর হবে।


হে সন্ন্যাসীবৃন্দ তোমাদের বলছি, ধর্মপ্রচারে বিঘ্ন যতই অধিক হোক, উপযুক্ত অধিকারী, যথোক্ত গুণসম্পন্ন আচার্য থাকলে, কেউ কখনও আমার মঠ উচ্ছেদ করতে পারবে না। যেহেতু আমাদের ধর্মই সনাতন। অর্থাৎ উপযুক্ত উপদেশকেই সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মের প্রচারে উপযুক্ত উপদেশকের অভাব হইলে সেই মঠ অকর্মণ্য।"


শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর বত্রিশ বছরের সামান্য আয়ুতে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত এখনো পর্যন্ত ১৫১ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেদ এবং বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য গ্রন্থের উপর ২২ খানা। এ ২২ খানা ভাষ্যগ্রন্থের মধ্যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে ধরা হয় ‘ব্রহ্মসূত্র’ ভাষ্য’কে। এ সূত্র ভাষ্যতেই তিনি তাঁর দার্শনিক তত্ত্বকে সুদৃঢ় ভিত্তিমূলে প্রতিস্থাপিত করেন। আত্মতত্ত্ব এবং প্রকৃত বৈদিক জীবন লাভের জন্য দিক-নির্দেশনামূলক আদেশ, উপদেশ এবং প্রকরণ গ্রন্থের সংখ্যা ৫৪ খানা। দেবদেবীদের স্তবস্তুতিমূলক গ্রন্থ ৭৫ খানা। প্রচলিত অধিকাংশ স্তব স্তুতিই এ গ্রন্থগুলি থেকে নেয়া। অসাধারণ তার ধ্বনিমাধুর্য এবং অসাধারণ তার পদলালিত্য।


আচার্যের জীবনের একটি প্রধান কীর্তি হল শ্রেষ্ঠ পবিত্র মন্দিরগুলোতে ভগবদ্বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। জগন্নাথ ধামে কালযবনের অত্যাচারকালে মন্দিরের সেবায়েত পাণ্ডাগণ জগন্নাথ বিগ্রহের উদর প্রদেশ স্থিত রত্নপেটিকা চিল্কা হ্রদের তীরে ভূগর্ভে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালক্রমে উক্ত স্থানের লোকেরা ভুলে যান রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে। আচার্য শ্রীশঙ্কর যোগবলে জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। বদরিকাশ্রমে নারায়ণ বিগ্রহও তিনি অনুরূপভাবে প্রকাশিত করেন।


আচার্য শ্রীশঙ্কর ছিলেন যুক্তিবাদিতার এক অত্যুজ্জ্বল বিগ্রহ। তিনি যুক্তি বিহীন কোন কথা বলতেন না। যে কথাই বলতেন তার পিছনে থাকতো তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি। সে অকাট্য যুক্তির জাল ছিন্ন করা ছিল দুঃসাধ্য। কারণ তিনি ছিলেন সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই তিনি যা বলেছেন তাই সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান ঘটালেন শুধুমাত্র যুক্তি, মেধা, প্রজ্ঞার সহায়তায়। না কোন রক্তপাত না কোন হানাহানি, না কোন রাজশক্তির ক্ষমতার অপপ্রয়োগে। কোন কিছুই ধ্বংস করেন নি, করেছেন সৃষ্টি, পুনঃপ্রবর্তন। বশিষ্ট-ব্যাসের ন্যায় মেধা প্রজ্ঞার সাথে অসাধারণ সারল্য, লাবণ্য ছিল তাঁর সারা দেহে, তাই তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।


আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শ্রীশঙ্করাচার্যের কথা ভাবলে গা রোমাঞ্চিত হয়, ভাবি শ্রীশঙ্করাচার্য কি একজন, না শত সহস্রজন! মাত্র বত্রিশ বছর, মহাকালের কাছে কতটুকু সময়! এ সময়ের মধ্যে একজন ব্যক্তি এত অসাধারণ কীর্তি কি করে করলেন; এই সামান্য সময়ের মধ্যে কিভাবে তিনি এত জনপদে ঘুরে বেরিয়েছেন; কি কৌশল অবলম্বন করে কোটি কোটি মানুষকে সনাতন ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে এসেছেন; এত ব্যস্ততার মধ্যেও কিভাবে তিনি ১৫১টা অমূল্য গ্রন্থের রচনা করেছেন; এবং এত সুসংবদ্ধ, অনন্য, অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা তিনি কোথায় পেলেন?


শ্রীশঙ্করাচার্যের সমতুল্য ব্যক্তি ভারতবর্ষে তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা শ্রীপাদ শঙ্করাচার্যের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারিনি। আচার্যের জীবনে আমরা দেখি যা কিছু সনাতন ধর্মের সমৃদ্ধিবাচক কাজ হয়েছে তা তাঁর জীবৎকালেই হয়েছে। তাঁর অন্তর্ধানের পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে চারমঠ আচার্যের জীবৎকালের ন্যায় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার কারণেই অনন্য অসাধারণ কাজের পরেও আচার্য শ্রীশঙ্করকে আমরা ভুলতে বসেছি। আজ শ্রীশঙ্করাচার্যের উক্তি বিভিন্ন গুরু এবং গুরুরূপী ভগবানগণ (!) নিজেদের নামে চালিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কারণ এ গুরু ব্যবসা করা কুম্ভীলকদের ধরবে কে? এর জন্য আমরাও কম দায়ী নয়। যতদিন যাচ্ছে তত বেশি করে আমরা মূলবৃক্ষকে ছেড়ে শাখা প্রশাখায় যেয়ে বসছি এবং তাকেই মূলবৃক্ষ বলে অভিমান করছি। সনাতন বৈদিক রাজপথ ছেড়ে কতগুলো অপরিচ্ছন্ন অলিগলিতে যেয়ে পথহারা পথিক হয়ে বসে আছি। অলিগলিতে চলতে চলতে আমরা টেরও পাচ্ছি না যে আমরা পথহারা। ভগবানের অবতারের নামে হাইব্রীড ফসলে সারা দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। ভণ্ড পাষণ্ড মিথ্যা অবতারদের কারণে সনাতন হিন্দু সমাজ নুয়ে নুয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মত পথের জঞ্জালে আমাদের যুবকসমাজ পথহারা, ভ্রান্ত, বিপথগামী হয়ে সনাতন ধর্ম, সমাজ এবং পারিবারিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। পরিণামে কেউ হচ্ছে মানসিক হীনমন্য, কেউ বেছে নিচ্ছে ধর্মান্তর, কেউবা হয়ে যাচ্ছে ঘোরতর নাস্তিক।


দক্ষিণ ভারতের একটি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়ায় জন্মগতভাবে শঙ্করাচার্যের মধ্যে জাতিবর্ণভেদের সংস্কারটি ছিলো, তাই তাঁর মতো মহাভক্ত বৈদান্তিককে জাতিবর্ণভেদ থেকে মুক্ত করার জন্যে ভগবান শিব চণ্ডালরূপে তাঁর সামনে প্রকটিত হয়ে, তাকে শিক্ষা দেন সকল জীবজগৎ আদতে একই ব্রহ্মের রূপ থেকে রূপান্তর মাত্র ; অর্থাৎ প্রত্যেকটি জীবের মাঝেই একই ব্রহ্ম বিরাজিত। এ পুরো ঘটনাটি আছে শ্রীশঙ্করাচার্যের মনীষা-পঞ্চকম্ নামক ছোট এটি গ্রন্থে। শ্রীশঙ্করাচার্যের মধ্যে যে যৎসামান্য জাতিবর্ণভেদের সংস্কার ছিলো এ দৈবী দর্শনে এ সকলকিছুই বিদূরিত হয়ে যায়।


"আমিই ব্রহ্ম, এই অখিল ব্রহ্মাণ্ড চিন্মাত্ররূপে বিস্তৃত, আমা কর্তৃক ত্রিগুণময়ী অবিদ্যা দ্বারা এ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কল্পিত হয়েছে, যে ব্যক্তির এইপ্রকার দৃঢ বুদ্ধি সুখময় নির্মল ব্রহ্মে অটলা থাকে, সে চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ যাই হোক ; সেই আমার গুরু এটাই আমার মত।"

(মনীষা-পঞ্চকম্ :৬)


জাতি বর্ণভেদের বিরুদ্ধে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন তাঁর আরো কয়েকটি স্তোত্রাবলীর গ্রন্থে।

ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদাঃ,

(নির্বাণ-ষটকম্ : ৫)

"আমার কোন মৃত্যু নেই, শঙ্কা নেই এবং কোনপ্রকার জাতিভেদ নেই।"

ন বর্ণা ন বর্ণাশ্রমাচারধর্মা

( নির্বাণ-দশকম্ : ২)

"আমার কোন বর্ণ বা জাতিভেদ নেই, তাই বর্ণাশ্রমবিহিত কোন আচারধর্মের বন্ধনাদিও নেই।"


শ্রীশঙ্করাচার্য কিভাবে সকল মানবকুল নির্বিশেষে কেমন একটি ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিকজাতির কল্পনা করেছেন তার একটি অনন্য উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত 'অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্' নামক গ্রন্থে। এ স্তোত্রের শেষ শ্লোকে তিনি উদাত্তস্বরে বলেছেন, তাঁর মা হলেন জগতের জননী পার্বতী এবং পিতা হলেন জগতের পিতা মহেশ্বর, আর জগতের জনকজননীর সন্তান সকল অর্থাৎ জীবসকল হলো পরমবন্ধু ; স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই হলো তাঁর স্বদেশ। 


মাতা মে পার্ব্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ ।

বান্ধবাঃ শিবভক্তাশ্চ স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্ ।। 

(অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্ :১২)


"জগতের মাতা ভগবতী পার্বতী হলেন আমার মা এবং জগতের পিতা দেব মহেশ্বর হলেন আমার পিতা ; আমার পরম বান্ধব হলেন জগতের পিতামাতার ভক্তগণ এবং স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই আমার স্বদেশ।"


আজ নিমজ্জমান হিন্দু জাতিকে রক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শ্রীশঙ্করাচার্যের ন্যায় তেজদীপ্ত নায়ক, সংগঠক, ব্রহ্মবাদী এবং ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী মহামানবের। সেই মহামানবই পারবে হিন্দু সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত জঞ্জালকে বিদূরিত করে এক ঐক্যবদ্ধ সুসংবদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে। তাই সেই নতুন এক সূর্যোদয়ের আকাঙ্ক্ষী হয়ে, সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছি আমরা সকলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :


"ওই মহামানব আসে,

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে॥

সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,

নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-

এল মহাজন্মের লগ্ন।

আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত

ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

উদয়শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’

নবজীবনের আশ্বাসে।"

লেখক পরিচিতি

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সহকারী অধ্যাপক,

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.