Breaking Posts

6/trending/recent
Type Here to Get Search Results !

শ্রী গোপাল মুখার্জি- ১৯৪৬-এর কালো দিনে কলকাতার হিন্দুদের রক্ষাকর্তা

 


© হিন্দু সংহতি টিম

যে জাতি রক্ষককে ভুলে যায় আর ভক্ষককে পূজা করে, সে জাতিকে বাঁচাবে কে? ১৯৪৬ সালের সেই ভয়ঙ্কর দিনটাতে কলকাতা শহরে হিন্দুদের রক্ষক ছিলেন গোপাল চন্দ্র মুখার্জি, আর ভক্ষক ছিলেন হোসেন শাহিদ সুরাবর্দি। গোপাল মুখার্জি কোনো নেতা ছিলেন না, রাজনীতি করতেন না। তিনি ছিলেন এক সাধারণ ব্যক্তি। আর সুরাবর্দি ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা এবং অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দিনটা ছিল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট। ১৯৪৬-এর এই দিনটাকে মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্নাহ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস(Direct Action Day) হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, ভারতকে ভাগ করে পাকিস্তান আদায়ের দাবিতে। দাবিটা সকলে বুঝেছিল, কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রামটা কার বিরুদ্ধে- সেটা হিন্দুরা বোঝেনি। আর সংগ্রামটা কিরকম, তাও বোঝেননি আমাদের পূর্বপুরুষরা। তাঁরা মনে করেছিলেন- এটা বুঝি গান্ধীর মতো ঝান্ডা নেড়ে অনশন করার মতো সংগ্রাম। তাই ১৬ই আগস্ট সকাল থেকে যখন মুসলিম লীগের পোষা গুন্ডারা কলকাতার কয়েকটি পাড়ায় আক্রমণ করা শুরু করে দিলো, তখনও হিন্দুদের চোখ খোলেনি। তাই বিকালে কলকাতার প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা মনুমেন্ট ময়দানে গিয়েছিল মুসলিম লীগ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ মিটিং শুনতে। সেই মিটিংয়ে একসঙ্গে বাঁধা হয়েছিল চাঁদতারা মার্কা সবুজ পতাকা ও কমিউনিস্টদের লাল পতাকা। মঞ্চ আলো করে একসঙ্গে বসে ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু, হোসেন সুরাবর্দি ও খাজা নাজিমুদ্দিন। সেই মিটিংয়ে মুসলিম লীগের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিলেন জ্যোতি বসু- 'আগে পাকিস্তান দিতে হবে, ভারত স্বাধীন হব।' 


বিকালবেলায় এই মিটিং শেষে ফেরার পথে মুসলিম লীগের সদস্যরা এবং গুন্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়লো ধর্মতলায় থাকা হিন্দু ও হিন্দুদের  উপরে। ১৯৪৬-এর ১৬, ১৭, ১৮ই আগস্ট গোটা কলকাতায় তিনদিন ধরে যে হত্যালীলা চললো, আধুনিক ইতিহাসে সে নৃশংসতা বিরল। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও নিরীহ হিন্দুরা মুসলিম লীগের গুন্ডাদের হাতে কচুকাটা হতে লাগলো। কলকাতার রাস্তা হিন্দুদের রক্তে লাল হয়ে গেলো। সর্বত্র মানুষের লাশ পড়ে। স্তব্ধ হয়ে গেলো জনজীবন। এই তিনটি দিনকে বর্ণনা করার মতো ভাষা মানুষের কাছে ছিল না। ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকা এই ঘটনার হেডিং করেছিল "The Great Calcutta Killing"। অন্য সাংবাদিকরা লিখেছিলেন  "Week of Long Knives"। 

ওই সময় একজন বিদেশী সাংবাদিক কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নাম ফিলিপ ট্যালবট। তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনও পক্ষভুক্ত না হওয়ায় তাঁর বর্ণনাকে গবেষকরা নিরপেক্ষ ও সঠিক বলে মনে করেন। এই সাংবাদিক 'Institute of Current World Affairs' সংস্থার প্রধান ওয়াল্টার রজার্সকে চিঠিতে লিখেছেন - "ভারতের বৃহত্তম শহর ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটা যেন নিজেকে নরখাদকে পরিণত করার কাজে লিপ্ত হয়েছে। শহরের সমস্ত রাস্তায় দোকানগুলির একটিরও দেওয়াল বা দরজা গোটা নেই। সমস্ত দোকান লুট হয়েছে। আর গুন্ডারা যেগুলো লুট করতে পারেনি, সেগুলো রাস্তায় ছড়ানো। আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের লাশ। টাটকা লাশ, গরমে পচে যাওয়া লাশ, অঙ্গহীন লাশ, থেঁতলে যাওয়া লাশ, ঠেলাগাড়িতে স্তূপাকারে রাখা লাশ, নর্দমায় লাশ, খালি জায়গায় জড়ো করে রাখা লাশ, শুধু লাশ আর লাশ! " 

ফিলিপ ট্যালবট আরও লিখেছেন - শুধু ৩,৫০০ লাশ সংগ্রহ করে গোনা হয়েছে, আর কত লাশ যে হুগলী নদী দিয়ে ভেসে গিয়েছে, কত লাশ হাইড্রেনে আটকা পরে আছে, কত লাশ যে দাঙ্গার আগুনে পুড়ে গিয়েছে, আর কত লাশ মৃতের আত্মীয়েরা তুলে নিয়ে গিয়ে সৎকার করে দিয়েছে- তার সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না। তিনদিন পর শহরে সেনা নামানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীর অনুমান- ৭০০০ থেকে ১০,০০০ জন মানুষ এই দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। 
এই বীভৎস হিন্দু গণহত্যার প্রত্যক্ষ নায়ক ছিলেন মুসলিম লীগের সুরাবর্দি। এই নরঘাতক মুখ্যমন্ত্রী সেদিন কলকাতার সভায় ঘোষণা করেছিলেন যে, পাকিস্তান দাবি আদায়ের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হবে। অর্থাৎ তিনি মুসলিম লীগের গুন্ডাদের প্রত্যক্ষ উস্কানি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ওই নরঘাতক সেদিন লালবাজারের পুলিশ সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমে বসে থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে হিন্দুদেরকে কচুকাটা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নিউ মার্কেট এলাকার বোম্বাইয়া, কর্ণওয়ালিশ বস্তির মিনা পাঞ্জাবি ও হ্যারিসন রোডের  চৌধুরী- এই তিনজন কুখ্যাত গুন্ডা আগে থেকেই মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা হিন্দু নিধনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। 

প্রাথমিক আঘাতের সেই প্রচন্ড ধাক্কায় হিন্দুরা যেন অবশ হয়ে পড়েছিল। প্রতিকার ও প্রতিক্রিয়া তো দূরের কথা, আত্মরক্ষাটুকু করতেও তাঁরা অসমর্থ ছিল। নেহেরু তখন দিল্লীতে অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ও তাঁর গুরু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী কলকাতার ই হত্যালীলার সময় নপুংসকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই হিন্দুরা মনে করেছিলেন যে এটাই তাদের নিয়তি। 

বাংলার ও কলকাতার হিন্দুর সেই অবশ ও বিবশ অবস্থার সময় দু'দিন পর সামান্য সাড়া ফিরিয়ে এনেছিলেন যে অল্প কয়েকজন অসমসাহসিক ব্যক্তি, তাদের মধ্যে প্রথম ও অন্যতম ছিলেন শ্রী শ্রী গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মধ্য কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলের মলঙ্গা লেনে তাঁর বাড়ি। বৌবাজারেই তাঁর একটি পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল বলে তিনি 'গোপাল পাঁঠা' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী অনুকূল চন্দ্র মুখার্জি তাঁর নিকট আত্মীয় ছিলেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আদর্শে বিশ্বাস করতেন। ফলে গান্ধীর অহিংসা নীতিতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইংরেজকে বলপ্রয়োগ করেই ভারত থেকে তাড়াতে হবে। কিন্তু কংগ্রেসের কিছু নেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশেষ করে তাঁর প্রতিবেশী কংগ্রেস নেতা ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। 

গোপাল মুখার্জি তাঁর মতাদর্শ অনুসারেই 'ভারত জাতীয় বাহিনী' নাম একটি ছোট সংগঠন পরিচালনা করতেন। বিপ্লবী চিন্তাধারা অনুযায়ী সেখানে শক্তি ও অস্ত্রের চর্চা হতো। এই সংগঠনটি সম্বন্ধে বেশি মানুষ অবহিত ছিলেন না। কিন্তু ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে হিন্দু গণহত্যার সময় গোপাল মুখার্জির নেতৃত্বে 'ভারত জাতীয় বাহিনী' কলকাতায় হিন্দু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। হিন্দু রক্ষায় ও মুসলিম দুষ্কৃতী দমনে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল গোপাল মুখার্জির অনুগামীরা। সেদিন কলকাতার হিন্দুদের চোখে তিনি পরিত্রাতা রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। 

এছাড়াও সেদিনের সেই গৃহযুদ্ধে হিন্দুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন শ্রী যুগলকিশোর ঘোষ। কলকাতা শহরের শিখ  গোয়ালারাও এই কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর সার্বিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। 

হিন্দুরা প্রথমে মার খেয়ে যখন পাল্টা মার  শুরু করল, তখন হিন্দু ঘাতক সুরাবর্দি ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করে সেনাবাহিনী নামালেন। কয়েকদিনের মধ্যেই মুসলিম লীগ বুঝতে পারলো যে তাদের ক্ষতির পরিমান বেড়েই চলেছে। তখন মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের প্রধান জি. জি. আজমিরী ও মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য শেখ মুজিবর রহমান(পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছে করজোড়ে অনুরোধ জানালেন এই রক্তপাত বন্ধ করার জন্য। 

 তারপর হলো নোয়াখালী। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অক্টোবর কোজাগরী পূর্ণিমার দিন থেকে পূর্ববঙ্গের দুর্গম জেলা নোয়াখালীতে আর এক সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ নেতা গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল হিন্দু নিধন। ইতিহাসের আর এক কালো অধ্যায়। 

এলো ১৯৪৭। ১৪ই আগস্ট দেশ ভাগ হবে, আগে পাকিস্তান জন্ম নেবে। তারপর ১৫ই আগস্ট ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ঠিক করেছিলেন - ঐদিন দিন তিনি দিল্লীতে থাকবেন না। নোয়াখালীতে গিয়ে নিপীড়িত হিন্দুর পাশে থাকবেন। সেই উদ্দেশ্যে ৯ই আগস্ট তিনি কলকাতায় এলেন। কিন্তু এখানে সুরাবর্দি ও মুসলমান নেতারা তাঁর কাছে অনুরোধ করলো তাদেরকে বাঁচাতে। কারণ, দেশভাগের ফলে পুলিশ বাহিনীর মুসলিম পুলিশরা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। ফলে এখানে তাঁরা নিরাপদ নয়। তাদের এই আবেদন শুনে গান্ধী নোয়াখালীর হিন্দুদের কথা ভুলে কলকাতাতেই থেকে গেলেন মুসলিমদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য। হিন্দুরা তাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। কিন্তু তিনি অবিচলিত থেকে হিন্দুদের কাছে আবেদন জানালেন, মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ত্যাগ করতে এবং সমস্ত অস্ত্র জমা করতে। গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে দু'বার গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করলেন অস্ত্র জমা দিতে। গোপালবাবু তাতে কর্ণপাত করেননি। তখন গান্ধীর সচিব গোপালবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি অস্ত্র জমা দিচ্ছেন না? গোপালবাবু তাকে দৃঢ়কণ্ঠে  উত্তর দিলেন - হিন্দুদের সম্মান রক্ষায় ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র তো দূরের কথা, একটা সুঁচ পর্যন্ত তিনি জমা দেবেন না।  

মেদিনীপুরে আজও রয়েছে সুরাবর্দির বাড়ি। ভারত বিভাজনকারী, হিন্দু গণহত্যাকারী হোসেন সুরাবর্দির বাড়ি আমরা এখনও যত্ন করে রক্ষনাবেক্ষন করছি। কিন্তু ১৯৪৬-৪৭-এ হিন্দুর পরিত্রাতা গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে আমরা ভুলে গিয়েছি। ইতিহাসকে যারা ভুলে যায়, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করে না। 

বর্তমানে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি জোটবদ্ধ মুসলিম ব্লক ভোটের দাসত্ব করতে গিয়ে ১৯৪৬-৪৭-এর হিন্দুর আর্তনাদ ভরা সেই রক্তাক্ত দিনগুলিক মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চায়। তার পরিণামে যে সেই দিনগুলোই আবার বাংলার গ্রামে গ্রামে ফিরে আসছে- এই ভয়ঙ্কর সত্যটিকে চাপা দিতে চায় তাঁরা। কিন্তু তা আর চাপা থাকছে না। দেগঙ্গা, ধুলাগড়, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, কালিয়াচক, ইলামবাজার, চোপড়া, ইসলামপুর, নলিয়াখালী, উস্তি, মল্লিকপুর, কালীগঞ্জ, হাঁসখালী, সমুদ্রগড় ও পঞ্চগ্রামের ঘটনা আবার বাংলার আকাশে অশনি সংকেত। 

এই অবস্থায় 'হিন্দু সংহতি'-র পক্ষ থেকে ১৯৪৬-৪৭-এর সেই ইতিহাসকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস আমরা করছি ১৬ই আগস্টকে সামনে রেখে। 

আসুন, এবছর আমাদের মাতৃভূমির বেদনাদায়ক বিভাজনের ৭৬ বছরে এই ১৬ই আগস্ট দিনটিতে হিন্দুর পরিত্রাতা আমাদের বীর পূর্বপুরুষ গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। সংকল্প নিই, জিহাদি মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা করা নয়। তাঁর শৌর্য বীর্য থেকে প্রেরণা নিই ও বাংলার মাটি রক্ষার শপথ নিই। 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.